বিদায় ২০১৬। স্বাগত ২০১৭। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজা মাত্রই অবসান ঘটলো পুরনো বছরের। দেখতে দেখতে কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলো আরো একটি বছর। শুরু হলো দেয়ালে নতুন বর্ষপঞ্জিকা টাঙানোর পালা। বিশ্বের নানা প্রান্তে নতুন বছরকে সাড়ম্বরে বরণ করে নিচ্ছে সবস্তরের মানুষ।
সবসময় নতুনেরই বিজয় কেতন ওড়ানো হয়। কালের রথ পেছনে ফেরে তাকাতেই চাই না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই তো গেয়েছেন- ঐ নতুনের কেতন উড়ে, কালবোশেখীর ঝড়; তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
নতুনের জন্য প্রতীক্ষা মানুষের আদিম নেশা। চারদিকে শোনা যাচ্ছে নতুনেরই আবাহন। 'থার্টিফার্স্ট নাইটের' শূন্য প্রহর পার হতেই আকাশে উঠবে নতুন সূর্য, সেইসঙ্গে দিন বদলের, নতুন স্বপ্নের মালাও গাঁথবে সবাই। হয়তো সে কারণেই উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে দেশের মানুষও স্বাগত জানাচ্ছে ইংরেজি নতুন বছর ২০১৭কে।
তবে যে বছরটি জীবনের খাতা থেকে মুছে গেলো, তার সবই তো বিস্মৃত হবে না। স্মৃতির মণিকোঠার মতো দেশের ইতিহাসে তা চিরঅমলিন হয়েই থাকবে। ঘটনাবহুল ২০১৬’র নানা কাঙ্খিত-অনাকাঙ্থিত ঘটনার রেশ ধরেই মানুষ এগিয়ে যাবে ১৭’র সিঁড়ি বেয়ে। নতুন স্বপ্ন বুনে অধরা সাফল্য ছুঁতে লড়বে সবাই।
অর্জন-বিসর্জনের ২০১৬
গেলো বছর উজ্জীবিত হবার মতো অনেক কিছুই ঘটেছে। পাশাপাশি কোনো কোনো ঘটনা জাতিকে করেছে বেদনা ভারাক্রান্ত।
বিদায়ী বছরে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। ছিল না আন্দোলনের নামে সহিংসতা। সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধে যা একটু আন্দোলন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
অর্থনীতির চিত্র ছিল স্বাভাবিক। বাণিজ্য-বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ছিল অনুকূলে।
বছরের সেরা অর্জনগুলোর একটি-ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্য তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তি।এটি আপামর মানুষকে করেছে আলোড়িত।
সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান ও রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না শেষপর্যন্ত কারামুক্ত হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন জাতিসত্ত্বাকে দিয়েছে নাড়া। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওপর পুলিশি সহিংসতাও দেশ-বিদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তোলে।
২০১৬তে বেশ ক’বারই রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। তবে তাতে সাড়া মেলেনি।
আদালত অবমাননার দায়ে দু’ মন্ত্রী আদালতে হাজির হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন রাজনৈতিক অঙ্গনে এনে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ আশান্বিত করে তোলে নেতাকর্মীদের।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি বড় দু’দলই জাতীয় সম্মেলন করেছে। আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। আর বিএনপির পূর্ণ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মুজাহিদ ও মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
বছরজুড়ে আলোচিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা ইস্যু। বছরের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিমান ত্রুটির বিষয়টি তোলপাড় সৃষ্টি করে।
২০১৬ সালে সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল জঙ্গি দমন।এক্ষেত্রে অনেকটাই সাফল্য এসেছে বলা যায়।
১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সংঘটিত হয় দেশের ইতিহাসে সবচে’ ভয়াবহ জঙ্গি হামলা।এর কয়েকদিন পর ঈদে শোলাকিয়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। এরপর কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, রূপনগর, আজিমপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাতে সফলও হয় তারা।
আগস্টে ঢাকা সফর করেন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।আর অক্টোবরে চীন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে বেশক’টি চুক্তি হয়। যা অর্থনীতি ও কূটনীতির ক্ষেত্রে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবার নজির স্থাপন করে।
এ বছর পদ্মাসেতুর কাজ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে দেশের মানুষকে কৌতুহলী করে তোলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা।
বছরজুড়েই গণমাধ্যম সরব ছিল নারী নির্যাতন ইস্যুতে। মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে উদ্ধার করা হয় ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী তনুর লাশ। জুনে তোলপাড় তোলে চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ড।
প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় আগস্টে বখাটের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা। অক্টোবরে সিলেটে কলেজছাত্রী নার্গিসকে কুপিয়ে হত্যার অপচেষ্টা চালায় ছাত্রলীগ নেতা বদরুল।
ভারত থেকে আসা বন্যহাতি বঙ্গবাহাদুর ৪৯ দিন নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
জানুয়ারিতে গাছের শেকড়ের মতো ৫ কেজি ওজনের হাত নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন খুলনার দাকোপ উপজেলার আবুল বাজানদার। দেশের ইতিহাসেও এরকম ঘটনা এটিই প্রথম।
এ বছরই কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। সেপ্টেম্বরে শুরু হয় জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) স্মার্ট কার্ড বিতরণ।
খেলাধুলায় এ বছর সর্বোচ্চ সাফল্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের টেস্ট জয়। এছাড়া আলোচনায় ছিল অলিম্পিক গেমস।
স্বপ্ন-সম্ভাবনার ২০১৭
দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। আয়তন মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তবে জন্যসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। পাকিস্তানের শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা চড়াই উতরাই অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা করতেও বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গেলো দু’দশকে দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধি সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
দেশের জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষা চর্চা আগের চেয়ে বেড়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের পরিবর্ধন উন্নতির চালিকাশক্তিরূপে কাজ করছে। উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প সারাবিশ্বে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। জনশক্তি রপ্তানি দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
গেলো দু’দশকে দারিদ্র্য অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সফলতা। তবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। এছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরো কতোটা স্বচ্ছ করা যায় তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সবার প্রত্যাশা, নতুন বছরে সব বাধা পেছনে ফেলে আরো এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। যেখানে সবুজ হয়ে উঠবে আরো সবুজ। রক্তে আর রঞ্জিত হবে না দেশ। যেখানে কেউ অনাহারে থাকবে না। একজন ভিক্ষুকও রাস্তায় দেখা যাবে না।
আমরা সেরকমই বাংলাদেশ চাই, যেখানে শক্তিতে রূপ নেবে শিক্ষা। কেউ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মাস্তানি করবে না। দেশ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দাঁড়াবে নিজের পায়ে। এক অন্যকে বাঁধবে ভালোবাসার ডোরে। যে দেশে ফুলে ছড়াবে তার মধুর ঘ্রাণ। আইনের শাসন, ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে মানুষ বুক ভরে শ্বাস নেবে। যে দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সত্যিকারে মুক্তি পাবে। শাব্দিক অর্থেই ‘হিউম্যান বিয়িং’ হয়ে উঠবে মানুষ।
ডিএইচ/এমকে